আমার কবিতা

রহস্যময়ী নারী (জুলাই ২০১৬)

প্রান্ত স্বপ্নিল
মচ মচ......
পিছনের বাগানের সুবিশাল বটবৃক্ষের খস খসে শুকনো একটি পাতা পড়ে কারো পা মাড়ানোয় ভেঙে গুড়িয়ে গেলো........
উফফ!!!!!!! ঘুম নামক শব্দটা রুমানের কাছে এখন অধরা মনে হয়।। যখন রাজ্যের শান্তিকে কাছে ডেকে এনে কাজগুলোকে একদিকে ফেলে রেখে মাথা আর বিছানার বালিশের মধ্যে সম্পর্ক গড়তে যাবে, ঠিক তখনই একটা না একটা উদ্ভট কাণ্ড তার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে...।। আজও তার ব্যত্যয় ঘটে নি।। কাল আবার তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওরিয়েন্টেশান ক্লাস।। কি যে হবে ?? এই ভেবে একটি ভালো ঘুম খুব দরকার ছিল।। ওটা আর তার পাশের বাগানের ঐ পাতাটা হতে দিলো কই?? তার কাজই হল শুকনো হয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া, অনেকটা প্রাণহীন হৃদয়ের মতো আর মানুষ নামক প্রাণীর কাছে বিরক্তির উদ্রেক করা। ঘুমটা যখন হলই না, এক কাজ করলে কেমন হয়?? কালকের জন্য পোশাক কোনটা পরে যাবে, তা না হয় দেখেই নেয়া যাক।। রুমান এই কাজটাতে বেশ অপটু, মেয়ে হলেও এই সাজগোঁজ তাকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ আকর্ষণ করে নি কোনদিনের জন্য।। এই চরিত্রটা তার নিজের কাছেই অদ্ভুত ঠেকে... তাই নতুন পোশাক কি পড়া যায় , সেইটা নিয়ে সে তুমুল গবেষণা শুরু করলো... চলল দীর্ঘ রাত ... আর সেই ঘুম!!! অচেনাই থেকে গেলো। নিপাত যাক ঘুম... সাথে শান্তিটাও !!!! নিশুতি রাতে একা একা চিলেকোঠায় দাঁড়িয়ে ভরা পূর্ণিমার চাঁদটা প্রানভরে দেখছে সে... আর তার পাশের জায়গায় খালি অংশটা বেশ বেমানান।। কিন্তু সে বুঝলে তো!! শুন্য আকাশের পানে চেয়ে সে ভাবছে আর ভাবছে...তার ভাবনার জগতে প্রবেশ করা টা বেশ দুঃসাধ্য।ঝলসানো রুটির মতো আকাশের চাঁদপানে চেয়ে থাকতে থাকতে কখন যে সূর্য্যি মামা পূর্বাকাশে তার অবস্থান জানান দিচ্ছিল, টেরই পেলো না সে। চিলেকোঠা হতে ঢুলু ঢুলু রক্তলাল চোখে বিছানায় শরীরটাকে কিছুটা বিশ্রাম দেয়ার জন্য এলিয়ে দিলো ।
ক্রিং... ক্রিং......!!!!! সকাল ৭টায় ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে উঠলো। প্রতিদিন এই সময়েই প্রানহিন এই বস্তুটি কিছুক্ষণের জন্য প্রাণ ফিরে পায় আর মানুষের নাক ছিটকানোর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ঈশ!!!! জীবন ঘড়িটা যদি এমন হতো, কি মজাটাই না হতো!!!! ...... ভাবছিল রুমান। সেই ভাবনার ছেদ ঘটাতে তার মায়ের আগমন আর মনে করিয়ে দিলেন আজ তার জীবনের বিশেষ একটি দিনের শুভ সূচনা।।
তখন সকাল ৯টা । রুমান তার পছন্দের কাপড়টা শরীরে কোনরকমে জড়িয়ে নিজেকে পাগলি হতে মানুষ করার সকল প্রচেষ্টা সম্পন্ন করলো। কোথায় যেন শুনেছিলো সে, দীর্ঘ নির্ঘুম রাতের কারণে মানুষের চেহারায় একটি পাগল পাগল ভাব চলে আসে । তারপর...... ছোট শিশুর মতো বাবার হাত ধরে সে বাসা হতে বেরিয়ে আসলো। শহরের বুক হতে বিশ্ববিদ্যালয়টার দূরত্ব কমপক্ষে ৪০ কি.মি.। বাসে চড়ে বসে মনে মনে তার গন্তব্য স্থানটির নাম আওড়াতে শুরু করলো সে। “ চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়”, সংক্ষেপে চুয়েট। বাবার স্বপ্ন ছিল মেয়েকে প্রকৌশলী বানাবে, সেই স্বপ্ন রুমান পূরণ করলো। আজ পাশে বসা মানুষটির মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। রুমানের মনটা ক্ষণিক মুহূর্তের জন্য খুব ভালো হয়ে গেলো। ভালোই হয়েছে, দূরত্বটা বেশি আর প্রকৃতির নির্মল ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে তার ভাবনাপিয়াসী মনের সাথে এই গাছপালাগুলো একাত্মতা ঘোষণা করবে। গেইটে পৌঁছেই ভালো করে গেইটের চারপাশটা দেখে নিল সে। লক্ষ্য করলো, বছর ২৫ এর একজন নিপাট ভদ্রলোক টাইপের যুবক সুন্দর করে সাজুগুজু করে বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর কারো জন্য অপেক্ষা করছে।। অতশত অপেক্ষা না করে সে ধীরলয়ে প্রবেশ করলো বাবার সাথে। তারপর সারিবদ্ধ গাছের এতো সুন্দর শৃঙ্খল দেখে সে রীতিমত বিস্ময়ে মুগ্ধ।
ওরিয়েন্টেশান ক্লাসটা শেষ হতে আর নানা আনুষ্ঠানিকতা সাড়তে বেলা প্রায় গড়িয়ে এল। বিকেলে যখন রুমান ছোট বাচ্চার মতো বাবার হাত ধরে বের হয়ে যাচ্ছে, তখন নিজেকে খুব অবোধ লাগছিলো। ব্যপারটা ভাবনায় আসতেই তার কেমন যেন হাসি পাচ্ছে...। চুয়েট গেইট দিয়ে যখন বের হচ্ছিলো, সেই সুদর্শন যুবককে সে আবার গেইট এর সামনে বেশ পায়চারি করতে দেখল। রুমানের আবার কৌতূহলী মন, সব ব্যপারেই তার “কেন” প্রশ্ন। সুতরাং এখন তার মন বলছে, সেই যুবকের অপেক্ষা করার কারণ জানাটা জরুরী।। কিন্তু সাথে বাবা থাকায় সে কিঞ্চিৎ বেকায়দায় পরেছে। তাই সে কৌতূহল টা চেপে রেখে বাসায় ফিরে গেলো।
প্রায় সপ্তাহখানেক গত হল... নতুন ক্লাস, নতুন বন্ধু, সব কিছুই নতুন। আর সম্পর্ক???? সেটার তো কোন কালাকাল নেই...কালের গর্ভ হতে যে সম্পর্কগুলো বেঁচে ফেরে সেই সম্পর্কগুলো চির নতুন, অবিনশ্বর। ভাবনার জগতে এর বিস্তৃতি অনেক ব্যাপক। কিন্তু সেই অকৃত্রিম সম্পর্কগুলোর গড়ে উঠা টা এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে অনেকটা দুঃসাধ্য। তাই রুমান নতুন সহপাঠীদের সহপাঠী বলতেই বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা পর্যন্ত তার অবাক লেগেছে , সেই সৌম্য আর মায়াবী চেহারার মানুষটি প্রতিদিন হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে কার জন্য অধীর আগ্রহে যেন অপেক্ষা করছে , সে প্রতিদিন ভাবে মানুষটার সাথে কথা বলবে কিন্তু কোন এক দৈব কারণে তা হচ্ছে না... তাই সে পণ করলো আজ যেভাবেই হোক তার সাথে কথা বলবে। সে ধীর পায়ে নুপুরের শব্দটাকে কোনরকমে আড়াল করে অনেকটা শঙ্কিত চিত্তে মানুষটার কাছে গেলো। শান্ত গলায় অত্যন্ত বিনয়ের সুরে তাকে বলল, “ আমি কি আপনার পাশে বসতে পারি??? তার ডাকে লোকটার কোন সম্বিৎ নেই।। সে একমনে ঘড়িটার দিকে চেয়ে থাকে আর মাথাটা একটু উপরে তুলে এদিক ওদিক তাকায়। কি অদ্ভুত লোকরে ,বাবা!!! রুমান দ্বিতীয়বার বলল, “হ্যালো, শুনছেন??? আপনাকেই বলছি , মিস্টার???” এমন কর্কশ আর গম্ভীর শব্দ শুনে ভদ্রলোক মুখটা তুলে পাশে ফিরে তাকাল, আর কিছুটা বিস্ময়ের সুরে বলল, “কে??? কবিতা?? পিয়ালি??? নাকি পিউ??” যুবকের মুখে এমন সব অদ্ভুত নাম শুনে রুমান কিছুটা থমকে গেলো আর অপেক্ষা না করে বালকের পাশের স্থানটি ত্যাগ করে চলে এলো। কিছুদূর আসার পর সে দেখল, সেই ছেলেটি তার পিছু পিছু দৌড়ুচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে “কবিতা............যেও না... আমাকে ছেড়ে যেও না...” অবস্থা অনুকূলে না দেখে রুমান দ্রুত একটি সি এন জি তে উঠে চলে আসলো। শঙ্কা কেটে গেলেও তার কৌতূহল টা আরও বেড়ে গেলো। বাসায় ফিরে সেই রাতে সে ছেলেটির আচরণগুলো নিয়ে বেশ গুরুগম্ভীর চিন্তায় পড়ে গেলো। মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে।। আসলেই কি এর সমাধান হবে??? গভীর দুশ্চিন্তা আর ভাবনায় ভারাক্রান্ত রুমানের মন কিছুটা স্থিধী হয়ে গেলো।
দেখতে দেখতে সকাল হয়ে এলো।। রুমান বিছানা ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুত হল। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লো। আজ সে নিভৃতচারীর গতিবিধি লক্ষ্য করবে। এই কৌতূহল এর সমাধান হতে পারে শুধু সে যদি আজ ফেলুদা হয়।গেইট এর সামনে পৌঁছুতেই রুমান এর কানে একটি কবিতা ভেসে আসলো,
“কবিতার বুকে লিখেছি একটি নাম, “পদ্য”,
ভালোবাসা???? সে যে নয় তো কোন গদ্য;
জীবন, তুমি নও কেন ছন্দোবদ্ধ ;
হায় অনুভূতি!!! তুমি রয়েছ সে আগেকার মতো সদ্য।।”
বাঁকা চোেখর চাহনিতে কান খাড়া করতেই রুমান সেই যুবকের কণ্ঠ শুনতে পেলো। আর ভাবছিল, এতো সুন্দর কবিতা সে কিভাবে বলছে!!!! আর কণ্ঠটাও মিষ্টি বেশ... নাহ মানুষটাকে খারাপ বলা যায় না। প্রথম দর্শনে একজন মানুষকে আর কতটুকুই বা চেনা যায়। এই মানুষ চেনাতে রুমান বেশ কাঁচা।হবে নাই বা কেন?? কিছু স্বার্থান্ধ বন্ধুর ভিড়ে সে মানুষ চিনতে বার বার ভুল করেছে। সেই সুবাদে এরকম অচেনা যুবককে বিশ্বাস করার কোন অবকাশ নেই। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল, ছেলেটার সাথে আর একবার কথা বলে দেখতে হবে। যুবকের মায়াবী চাহনি রুমানকে বেশ আকর্ষণ করছিলো।
ছুটি শেষে অনেকটা নির্ভয়ে সে যুবকের কাছে গেলো। যে ছেলে এতো সুন্দর কবিতা রচনা করতে পারে, তার পক্ষে মানুষের রক্তপাত নিছক একটা প্রহসন। তাই, রুমানের শঙ্কা অনেকটাই আজ মৃত। আজ সে পাশে না বসে ছেলেটার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। রুমানের এরকম অবস্থান দেখে সে হতছকিয়ে গেলো। তারপর গম্ভীর আর ধীর গলায় বলল, “কাল এভাবে পালালে কেন??” রুমান কিছুটা অবাক হল, সে এমন ভাবে কথা বলছে, যেন সে তার কত বছরের চেনা!!!! রুমান জবাব দিলো, “ আপনি এমন সব উদ্ভট নামে ডাকছিলেন, আসলে আমি ভয় পেয়েছিলাম, তাই আমার দ্রুত প্রস্থান... ছেলেটা মাথা নিচু করে কি যেন ভাবল, তারপর উত্তর দিলো “হুম, জানতাম তুমি আমার কবিতা নও, আমার কবিতা কখনও এভাবে ছেড়ে আমাকে যেতে পারে না”। রুমান কিছুটা নরম সুরে বলল, “কবিতা কে?” কিছুক্ষণের জন্য যুবক কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে গেলো। তারপর মাথা তুলে অসহায় চেহারায় বলল, “শুনবে?? শুনবে আমার কবিতা কে?? আমার কবিতার গল্প???.........”ছেলেটার মুখে এমন উৎসাহ আর উত্তেজনা দেখে রুমান কিছুটা অবাক হল। তারপর সে বলল, “অবশ্যই, কেন নয়??” রুমানের মুখে এমন আশার বানী শুনে স্মিত হেসে সে বলল, “ কতজনকে আমার কবিতার গল্প বলতে চেয়েছি, জানো??? কিন্তু কেউই কথা শুনে নি, আবার কেউ বা আশ্বাস দিলে কথা রাখে নি, যাক বাবা তোমাকে পেলাম...” রুমান অতি উৎসাহে বলল, “শুরু করুন তবে, আপনার কবিতার গল্প”। সে বলতে শুরু করলো, অনেকটা গল্পকারের ভঙ্গিতে একটি ছোট গলা খাঁকারি দিয়ে, “ আমার কবিতার আসল নাম পিয়ালি রুদ্র পিয়া। তার কণ্ঠ এতো মিষ্টি ছিল, কতবার শুধু তার কণ্ঠটা শুনার জন্য এই ক্যাম্পাসে কারণে অকারণে ছুটে এসেছি,তার ইয়ত্তা নেই। তাই নাম দিয়েছিলাম পিউ।তার আগমনে আমার কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিলো বলে তার ডাক নাম দিয়েছিলাম কবিতা।রুমান বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনি শুধু তার নামগুলোই বলে যাচ্ছেন, নতুন কিছু তো বলুন”। “ আরে বাবা বলছি, এতো অধৈর্য হলে চলে নাকি????” সে বলল। তারপর সে শুরু করলো, “ জানো, সে শুরুতে আমাকে একটুও পছন্দ করত না।। কিন্তু কি করবো বল, তার চোখে আমার জীবনের সাজানো স্বপ্নগুলোর এক রঙিন জলখেলি দেখতাম, তাই বারে বারে তার চোখের কর্নিয়াতে নিজের মনটাকে ক্ষণিকের জন্য সমর্পণ করতাম”। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমান বলল, “হুম, এরপর??” যুবক আবার শুরু করলো, “ একদিন রাতে বেশ কনকনে শীত পড়ছিল, হলে যাব বলে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। গেইটে ঢুকতেই দেখি আমার মহারানী একটি ছোট চাদর গায়ে মুড়িয়ে কোন রকমে শীতের প্রকোপ হতে রক্ষা করে ধীরে ধীরে ভিতরে প্রবেশ করছে। আমি না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছি, হঠাৎ পেছন হতে সুললিত কণ্ঠের মিষ্টি ডাক, “ এই যে শুনছেন???” আমি কি আর না গিয়ে পারি, বল তো ?? সে কাছে এসে বলল, আসলে আজ শহর হতে আসতে দেরি হল, রাত ও অনেক গভীর হয়েছে, তাই গার্লস হোস্টেলে একা একা যেতে ভয় লাগছে।। একটু এগিয়ে দিবেন, প্লিজ???” আমিও বিজ্ঞ ব্যক্তির ভাব নিয়ে বলে ফেললাম, “ এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকাটা ঠিক হয় নি”। ও এক পা এগুচ্ছে আমিও এক পা এগুচ্ছি, মাথায় হঠাৎ দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। তাকে একটি বেকায়দামূলক প্রশ্ন করলাম। বললাম, এতো রাতে একা একা একটি অপিরিচিত ছেলের সাথে তুমি নিরাপদ বোধ করছ??উত্তরে সে বলল, “আপনি তো আমার ক্লাসমেইট । এতটুকু ভরসা তো করতেই পারি, তাই না??? আমি বললাম, “আমি তো খারাপও হতে পারি” সে এবার ভয়ে কুঁকড়ে গেলো। মিন মিন করে সে বলল, “ আপনাকে দেখে তো মনে হয় না...” এবার কিছুটা রাগত স্বরে বললাম, “দেখ বালিকা, এভাবে ‘আপনি আপনি’ করলে অনর্থ হবে কিন্তু।। “তুমি” সম্বোধনে আল্যারজি আছে কি??এই কথা শুনে সে সত্যি ভয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো। ইশ, অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো। হোস্টেল এর কাছাকাছি আসতেই তাকে দুঃখ প্রকাশ করে বিদায় দিলাম। পরদিন সকালে টিফিন পিরিয়ডে বালিকা পিট পিট করে আমার দিকে তাকাচ্ছিল ,বুঝে নিলাম সে কিছু বলতে চায়, অতঃপর কাছে এসে বলল সে, “কালকের জন্য দুঃখিত। তোমাকে তুমি বলেই ডাকব আর সঙ্গ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমি তখন সাতরঙা রঙধনুর চূড়ায় অবস্থান করছি। আমার মনে তখন কঠিন আধুনিক গান বেজে চলেছে, “ বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও”। মনের রং কি আর সহজে যায়!!! এরপর তার সাথে নিছক কারণ ছাড়া কথা বলতাম, সময়ে অসময়ে বিরক্ত করতাম। কিন্তু তার মধ্যে এই নিয়ে কোন ক্ষোভ ছিল না বৈকি”। যুবক এবার কিছুটা ক্লান্ত হয়ে বলল রুমানকে “ আচ্ছা, তুমি কি বিরক্ত হচ্ছ?” তার প্রশ্নে রুমানের ঘোরটা ভাঙল, বলে উঠলো “ না, না কি যে বলেন!! খুব ভালো লাগছে , তারপর বলুন, থামলেন কেন??” সে শুরু করলো, “ এরপর তাকে অনেকভাবে বোঝাতে চেয়েছি, আমার অবুঝ মনের কথা। কিন্তু সে বুঝলে তো?? নাহ, এভাবে আর হয় না। আমার মনে তখন সুনামি বয়ে যাচ্ছে। সাহিত্যিকের ভাষায় “প্রেম অনল” শব্দটা শুনেছি বার কয়েক, কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ আমার ক্ষেত্রেই হবে ভাবিনি কখনো। যে অনলের দহনে অন্তর পুড়ে খাক হয়ে যাবে কিন্তু এর তেজ কমবে না বরঞ্চ দ্বিগুণ হারে বাড়বে। সিদ্ধান্ত নিলাম, মনের কথাটা জানিয়েই দিই, পরে আবার মনের বদহজম হলে উগলাতে পারবো না। কিন্ত গতানুগতিক নয়, একটু ভিন্ন ধাঁচে, ভিন্ন ছাঁচে...
সকাল সকাল ক্লাস শেষ হয়ে গেলো। আজই সুযোগ, তাকে দেখার সাথে সাথে ডাক দিলাম, “এই যে বালিকা, শুনছ??” সে দাঁড়িয়ে গেলো, কাছে এসে বললাম, তোমার সাথে আমার একটু কথা ছিল, সময় হবে একটু???” সে খানিক ইতস্তত করে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে , হাঁটতে হাঁটতেই না হয় কথা বলি”। আমার মনদেব বলে উঠলো, “উত্তম প্রস্তাব”... তারপর বললাম “ঠিক আছে, চলো; আচ্ছা তোমার এমন কিছু চাওয়া আছে যা তোমার সাধ্যে থেকেও সাধ্যাতীত??” বালিকা এক নিঃশ্বাসে জবাব দিলো, “আছে তো?? বলবো??” আমি ও বলে ফেললাম, “থামলে কেন... বলে ফেলো...” সে উত্তর দিলো, “ ঐ নীল আকাশটা... আমার দেখার সাধ্য আছে তবে ছোঁওয়ার সাধ্য নেই ,এবার বল এই প্রশ্ন কেন করলে??” “আচ্ছা আমি যদি এই অসাধ্য সাধন করি , তবে কি দিবে তুমি আমায়??? “ সে কি যেন ভেবে বলল, “ মন চাও তো আমার?? যাও, পাবে......” এহেন উত্তরে আমি হতবিহব্বল হয়ে বোকার মতো তার দিকে চেয়ে আছি” আমি নির্বাক হৃদয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, “ তুমি কিভাবে জানলে??” সে কিছু না বলে মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো আর বলল কাল সকাল ৭টায় খোলা মাঠে চলে এসো, একটু আকাশটা ছুঁয়ে দেখবো”... এখন তো বোধহয় মহাফাপরে পড়লাম। বলে তো দিয়েছি, কিন্তু করবো টা কিভাবে?? এই প্রশ্নের সমাধানে পুরো রাত ব্যয় করলাম, কিন্তু উত্তর মেলল না। সকালে রক্তজবা চোখে ভোর সাড়ে ছয়টায় হিমশীতল ঠাণ্ডায় হাতে পায়ে কষ্ট করে পানি ছিটিয়ে পাতলা চাদর মুড়ি দিয়ে বের হলাম হল থেকে। কিন্তু এখনও যে কাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছি তার কোন সমাধান মেলে নি। খোলা মাঠে প্রবেশ করতেই দেখি সফেদ চাদর গায়ে দিয়ে উনি মহাউৎসাহে শীতের ঠাণ্ডা হাওয়ার মজাটা লুফে নিচ্ছেন আর আমি বেচারা ঠাণ্ডায় মাথাটা ঠিকমতো কাজ ও করছে না। তার কাছে যেতেই সে ঘুরে তাকাল। তার নিরীহ চেহারার ভয়ানক সৌন্দর্য দেখে আমার রীতিমত অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অবস্থা। লিপজেল দেয়া চকচকে বাঁকা ঠোঁটে এক গাল হাসি দিয়ে বলল সে, “আমার আকাশ কোথায়??” কি যেন নিজে নিজে ভাবলাম। তারপর তাকে বললাম, দশটা মিনিট অপেক্ষা করা যায় আর??” সে দুষ্টুমির ভঙ্গিতে বলল, “যায় গো, প্রিয়তম যায়”। সাথে সাথে দৌড়ে একটি কাঁঠাল গাছের নিচে গেলাম আর সুন্দর দেখে একটা পাতা নিলাম। রুমান প্রশ্ন করলো, “ এই কাঁঠাল পাতা দিয়ে আকাশ দেখাবেন!!!! বড্ড মজার মানুষ তো আপনি!!!!!” যুবক কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বলল, “আরে বাবা শোনই না। সে কাঁঠাল পাতাতে কয়েক ফোঁটা শিশির সংগ্রহ করলাম। তারপর দ্রুত পাতা হাতে নিয়ে মাঠে ফিরে গেলাম। আমাকে কাঁঠাল পাতা হাতে দেখে বালিকা আমাকে ছাগলের সাথে মেলানো শুরু করলো, কি লজ্জায় পড়লাম রে বাবা”। বালকের কথা শুনে রুমান না হেসে পারল না। তারপর সে বলে উঠলো “এরপর??”... “ তখন ভোর ৭.০০ টা কি ৭.৩০ হবে, দেখলাম সূর্য তার মিষ্টি রোদের হাসি দিয়ে নাকের ডগায় এসে হাজির। তখন কবিতাকে ডাকলাম। বলেছিলাম না আকাশ ছোঁয়াব, এবার দেখো। পাতাটা হাতে নিয়ে সূর্যের আলোয় নিয়ে গেলাম, সাথে সাথে সেই নীল আকাশের প্রতিফলন এসে পড়লো ঐ শিশির বিন্দুতে। বালিকা এক পবিত্র চাহনি দিয়ে হাত দিয়ে ঐ শিশির স্পর্শ করে দেখল। সেই আকাশের বুকে সাত রঙা রংধনুর ছোঁয়া ছিল, ছিল একরাশ ভালোবাসা, আকাশের উড়ে যাওয়া ধূসর সাদা মেঘগুলো যেন জানান দিচ্ছিল, “ কবিতা...... অনেক ভালবাসি তোমায়, আকাশের চেয়েও বেশি......” কবিতা লাজুক ভঙ্গিতে আমার দু হাত স্পর্শ করলো আর তার লাজুক দৃষ্টি নিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “ পদ্য, ভালবাসি তোমায়”। সেই থেকে আমাদের কাশফুলের মতো শুভ্র ভালোবাসা চলছে। কত আনন্দ, হাসি ঠাট্টা, রাগ-অভিমান, আমার কবি হয়ে উঠা, পিউ’র কবিতা হয়ে উঠা, মিষ্টি মিষ্টি কথা আর আমাদের ভবিষ্যতের ভাবনা। জানো, আমি আমাদের ছেলেমেয়েদের নাম ও ঠিক করে রেখেছি?? আমাদের একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হবে, ছেলের নামটা রাখবো “ইটুস” আর মেয়ের নাম রাখবো “কুটুস”।এতো সুন্দর হতে পারে ভালোবাসা, এ জীবনে কবিতা না এলে বুঝতেই পারতাম না হয়তো। সে আমার কাছে উদ্ভট উদ্ভট সব বায়না করতো। কখনো বলতো জোনাকি পোকার মিট মিট আলোটাকে ছুঁয়ে দেখবো, আবার কখনো বলতো প্রকৃতির বুকে মাথা পেতে আমার ভালোবাসার গন্ধটা পেতে চায়। ভালোবাসার রং-রুপের কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু গন্ধ!!! কবিতার মুখেই প্রথম শুনলাম।তার কিছু কথা শুনে মনে হতো ভালোবাসার স্কুলে আমি শিশু শ্রেণীতে পড়ছি আর কবিতা সে স্কুলের হেডম্যাডাম। ভালোবাসা নিয়ে তার নিজস্ব একটি সংজ্ঞা আছে যা সময়ে অসময়ে কাঁদায় আজও, “ ভালোবাসা মানেই শুধু কাছে থাকা নয়, নয় ফোনালাপনি; নয় হাতে হাত ধরে কিছু নিছক বানানো কথা, চোখ বন্ধ করলেই যার ছোঁয়া অনুভব করা যায়, দীর্ঘ অনুপস্থিতি যার অস্তিত্বকে বেশ শক্তভাবে জানান দে, তাকেই হয়তো বা ভালোবাসা বলে”।ভালোই চলছিলো সবকিছু।
কিন্তু.........তারপর প্রায় দু’বছর গত হল। হঠাৎ একদিন কবিতাকে ক্লাসে না পেয়ে তার বন্ধুদের কাছ হতে খবর নিলাম। তারা বলল, কবিতা তার বাবার সাথে শহরে গেছে। এরপর............... (দীর্ঘশ্বাস)!!!!!” “ এরপর কি হল?” জিজ্ঞাসা করলো রুমান। যুবক ছল ছল চাহনিতে বলল, “ জানি না............” রুমান বলে উঠলো, “ আপনি এখনও তার জন্য অপেক্ষা করছেন???? সে কি আদৌ আসবে????” যুবক ত্বরিত উত্তর দিলো, “ এভাবে বল না, সে আসবে, নিশ্চয় আসবে, হয়তো বা কোন কারণে কোথাও আটকা পড়েছে। আসবে সে...... আসবে...” যুবকের চোখ হতে এক ফোঁটা দু ফোঁটা করে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। রুমানের চোখের কোনায়ও পানির মতো কি যেন জমা হচ্ছে। সে আজ ভাবছে, যুবক তো তার সম্পর্কের বাঁধনে পড়ে না, তবে কেন তার আজ এতো অসহায় লাগছে, তাহলে কি ভালোবাসা জাগতিক সম্পর্কগুলোকেও হার মানায়???? জীবনের নগণ্য কয়েকটি ঘণ্টা একজন মানুষের বক্তব্যের মুগ্ধ শ্রোতা ছিল সে, তবে কেন তার চোখে এই অশ্রু??? রুমানের মনে এখন অসম্ভব ভাবনা খেলা করছে, নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনাকে চেপে ধরে বিবেকের বোকা বোকা ভাবনাগুলোকেই আজ তার প্রাধান্য দিতে ইচ্ছে করছে। আসলেই কি তা সম্ভব???......
পরদিন সকালে যুবককে আর দেখা গেলো না। রুমান তাকে পাগলের মতো খুঁজল। অবশেষে এক বছর সাতেকের ছেলেকে তার কথা জিজ্ঞাসাতে সে হেসে বলল, “ আপনি কার কথা কন, আপা?? ঐ পাগলটা যে ঘড়ি চাইয়া চাইয়া বইয়া থাকতো??? হে তো চইলা গেছে আইজ সকালে এই দিক দিয়া?? বড্ড ভালো পাগল ছিল গো আপা......” শিশুটির মুখে এসব কথা শুনে রুমান ক্ষণিক সময়ের জন্য কথা হারিয়ে ফেললো। আসলেই ভালোবাসা কি এমন??? ............ রুমান হাঁটছিল আর চোখের কোনে জমে থাকা জলটা আজ পড়েই গেলো। কেন যে এই চোখ বাঁধ মানল না, তা সে নিজেই জানে না। তার অন্তরে এখনও বেজে চলেছে কবিতার কবিতা,আর যুবকের মিষ্টি কণ্ঠ যেন বলে বেড়াচ্ছে “হায় অনুভূতি!! তুমি রয়েছ সে আগেকার মতো সদ্য”........................
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
কাজী জাহাঙ্গীর ওকে, ভাল লাগার ভোটটাও রইল, শুভেচ্ছা।
জাহাঙ্গীর ভাই, ধন্যবাদ আপনাকে। পাঠক হিসেবে আপনাকে পেয়েছি, এটাই আমার লেখার সার্থকতা। দোয়া করবেন আর আপনি ও সুস্থ এবং ভালো থাকুন এই প্রার্থনা করি
কাজী জাহাঙ্গীর প্রান্ত, ভালবাসার গল্প ভাল না লেগে যায় কথায়,তবে বিষয়টা রহস্যময় পুরুষ হয়ে গেল আরকি ,হা হা হা......
কেতকী ভালোবাসা মানেই শুধু কাছে থাকা নয়, নয় ফোনালাপনি; নয় হাতে হাত ধরে কিছু নিছক বানানো কথা, চোখ বন্ধ করলেই যার ছোঁয়া অনুভব করা যায়, দীর্ঘ অনুপস্থিতি যার অস্তিত্বকে বেশ শক্তভাবে জানান দে, তাকেই হয়তো বা ভালোবাসা বলে...কথাটা খুব মনে ধরেছে। যুবকের জন্যে মন খারাপ হয়ে গেল। গল্পে ভোট রইল।
ধন্যবাদ দিদি। এতো সুন্দর বিশ্লেষণ করে বলেছেন!!!!!! খুব ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা রইল
নিয়াজ উদ্দিন সুমন কলম চলুক নতুন কিছু সৃষ্টির প্রয়াসে... শুভ কামনা।
ধন্যবাদ সুমন ভাই, শুভাশিস আপনাকেও
ইমরানুল হক বেলাল kub sondor kore sajiye liklen bhai, golpo lekhar darabahikota onek gobir, sobdo gotone kono protibondokota nei, pore mugdo holam, sobokamna roilo, aponar sahittokormo ujjibit hok duya kori.
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এতো সুন্দর বিশ্লেষনের জন্য। আপনাদের অনুপ্রেরণাই আমাদের চলার পথের পাথেয়। ভালো থাকবেন। শুভ কামনা রইল।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এতো সুন্দর বিশ্লেষনের জন্য। আপনাদের অনুপ্রেরণাই আমাদের চলার পথের পাথেয়। ভালো থাকবেন। শুভ কামনা রইল।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এতো সুন্দর বিশ্লেষনের জন্য। আপনাদের অনুপ্রেরণাই আমাদের চলার পথের পাথেয়। ভালো থাকবেন। শুভ কামনা রইল।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,ভোট রেখে গেলাম।কবিতা পড়ার আমন্ত্রন রইল।

২৫ জুন - ২০১৬ গল্প/কবিতা: ৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪